|

রান্নাঘরে ঘরোয়া রূপচর্চার উপাদান: প্রাকৃতিক উপাদানে ত্বক সুন্দর ও উজ্জ্বল করার উপায়

Share this post:

সৌন্দর্য্যে-লাবণ্যে নজরকাড়া হয়ে ওঠা সকল নারীর স্বপ্ন। কিন্তু সংসারের হাজারো ঝক্কি সামলে নিজের রূপচর্চার সময় কোথায়? তাহলে কি নিজের ত্বকের কথা ভাববেন না? অকালে নিজের সৌন্দর্য ফুরিয়ে যেতে দেবেন? তা আবার হয় নাকি? এই প্রবন্ধে আপনি পাবেন ৭টি ঘরোয়া রূপচর্চার গোপন রহস্য যা রান্নাঘরের সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করে আপনাকে দেবে উজ্জ্বল ও নিখুঁত ত্বক।

বিউটি পার্লারে গিয়ে নিজের যত্ন নেওয়ার কথা তো ভাবনার বাইরে। আর নামী দামী ব্র্যান্ডের খরচ ও আকাশ ছোঁওয়া। আর শুধু নামী দামী product কিনলেই তো হল না, সেটা আপনার ত্বকে সহ্য (suit) হবে কি না সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। সাথে থেকে যায় side effect এর সম্ভাবনা। বাড়িতে থেকে বাড়তি সময় ব্যয় না করেও আপনি হয়ে উঠতে পারেন সকলের মধ্যমণি । রান্নাবান্না করতে করতেই পেয়ে যেতে পারেন ঘরোয়া রূপচর্চার মাধ্যমে নজর কাড়া সৌন্দর্য। আর তাও একেবারেই বিনা খরচে।

অবাক হচ্ছেন তো? আপনি হয়তো জানেন না- আপনার রান্নাঘরেই রয়েছে মূল্যবান সব উপাদান। প্রতিদিন অনাদরে কতো beauty product আপনি ফেলে দিচ্ছেন ভাবতেও পারবেন না। জেনে নিন এই অত্যন্ত উপকারি জিনিস কোনগুলো , কোন্ সমস্যায় কীভাবেই বা সেগুলো ব্যবহার করবেন । এই প্রতিবেদনে রইল ঘরোয়া রূপচর্চার (home beauty tips) খুটিনাটি।

রান্নাঘরে রাখা ঘরোয়া রূপচর্চার ৭ কার্যকর উপকরণ

রান্নাঘরে রাখা ঘরোয়া রূপচর্চার ৭ কার্যকর উপকরণ

আলু (Potato)

রান্নাঘরের খুব সাধারণ উপকরণ আলু। অথচ ঘরোয়া রূপচর্চার উপাদান হিসেবে এর কোন জুড়ি নেই । আলুতে আছে ভিটামিন সি (Vitamin C) ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (vitamin B complex) , পটশিয়াম(Potassium), ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium), ফসফরাস (Phosphorus)এবং জিঙ্ক (Zinc) । আলুতে থাকা উপাদানগুলি প্রাকৃতিক ব্লিচিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। যা ত্বকের উপরিভাগের রঙ হালকা করে, কালো দাগ দূর করে এবং ত্বকে একটা সুন্দর উজ্জ্বল ভাব এনে দেয়। চোখের চারপাশের কালো দাগ ও রোদপোড়াভাব (tan) কমাতে আলুর রসের জুড়ি নেই।

সুন্দর ত্বকের জন্য আলু কীভাবে ব্যবহার করবেন?

  • আলু পরিস্কার করে ধুয়ে সামান্য থেতো (grate) করে নিন। ত্বকের affected জায়গায় লাগিয়ে নিজের কাজ করতে পারেন। শুকিয়ে গেলে জল (normal water) দিয়ে ধুয়ে নিন।
  • রোদে বেরোলে অনেক সময় মুখে ট্যান পড়ে যায়। আলু খুব পাতলা করে কেটে নিয়ে মুখে লাগিয়ে  রাখুন কিছুক্ষণ। এতেই দাগ দূর হয়ে যাবে।
  • আলুর রস, বেসন, লেবুর রস, মধু, টমেটো মিশিয়ে পেস্ট বানিয়েও লাগাতে পারেন। এতেও ভালো কাজ হয়।
  • আলু দিয়েও চোখের ক্লান্তি দূর করা যায়। এর জন্য প্রথমে পাতলা করে আলু চাকা (sliced potato)করে কেটে নিয়ে চোখের উপর চাপা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো রেখে শুয়ে পড়ুন। ডার্ক সার্কেল  থেকে শুরু করে চোখের ফোলাভাব কমে যাবে।
  • ত্বককে উজ্জ্বল করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আলু কুরিয়ে তিন টেবিলচামচ রসের সঙ্গে দু’টেবিল চামচ মধু ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এবার এই মিশ্রণটি মুখে ও গলায় মেখে ১০-১৫ মিনিট রাখুন। শুকিয়ে যাওয়ার পর ধুয়ে ফেলুন এবং আয়নায় দেখুন ত্বক কতটা উজ্জ্বল হয়েছে।
  • শুধু ত্বক নয়, চুলের পরিচর্যায় আলুর ভূমিকা অনেক।  আধ কাপ আলুর রস মাথার ত্বকে ৫-১০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। স্ক্যাল্প ম্যাসাজ হয়ে গেলে পুরো চুলে আলুর রস লাগিয়ে নিন। ১৫ মিনিট রাখার পর মাথা ধুয়ে ফেলুন। এতে ফলিকল পুষ্টি পাবে, scalp পরিস্কার হবে , চুল হবে ঝলমলে।

টমেটো (Tomato)

ঘরোয়া রূপচর্চার আর একটি অতন্ত্য উপকারী উপাদান হলো টমেটো। ত্বকের সুরক্ষায় টমেটো খুব ভালো ফল দেয়। Tan remove আর open pores এর সমস্যা রুখতে টমেটো অনবদ্য।

ত্বকের যত্নে টমেটো কীভাবে ব্যবহার করবেন?

  • টমেটো কাটার সময় এর অর্ধেক অংশ আলাদা করে নিন। এর পর সেই অর্ধেক টমেটোয় সামান্য হলুদ মিশিয়ে নিজের মুখে ভালো ভাবে ঘষে নিন। রান্না করতে করতে সহজেই এটি করা যায়। আধ ঘণ্টা লাগিয়ে রাখার পর মুখ ধুয়ে নিন। এর ফলে ত্বকের ট্যানিং দূর হবে । skin কতটা উজ্জ্বল হবে তা নিজেই দেখে অবাক হবেন।
  • রোমকূপ বড় ( Open pores) হয়ে গেলে ত্বকে সহজেই ময়লা ও জীবাণু প্রবেশ করে। আর এর থেকে ব্রণসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এইসব সমস্যা দূর করতে এক টেবিল চামচ টমেটোর রসের ৪ ফোটা লেবুর রস মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে সার্কুলার মোশন-এ ম্যাসাজ করুন। ১৫ মিনিট পরে ঠাণ্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • টমেটো শুধু মুখের ত্বকের যত্ন নেয় তা নয়। ঘাড়, গলা, হাত ও পায়ের যত্নেও টমেটোর জুড়ি নেই। এজন্য টমেটোর রস, শসার রস ও লেবুর রস একসঙ্গে মেশান। ওই রসে তুলার বল ডুবিয়ে ঘাড়ে, গলায়, হাতে, পায়ে লাগিয়ে নিন। এরপর শুকিয়ে গেলে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে নিন।

লেবু (Lemon)

ফ্রিজের কোণে পড়ে থাকা পাতিলেবু ঘরোয়া রূপচর্চার জন্য অত্যন্ত। লেবুর রস কালো দাগ দূর করতে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। লেবুর রসে থাকা ভিটামিন সি ত্বকের কোষকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।

ত্বকের যত্ন ও তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যা সমাধানে লেবু কীভাবে ব্যবহার করবেন?

  • পাতিলেবুর রস ত্বকের কালো দাগ, নখের ময়লা পরিস্কার করে। চাইলে ভাতের পাতে লেবু চিপে নেয়া সেই কোয়াটি ব্যবহার করতে পারেন। তাহলে আর আলাদা ভাবে লেবু অপচয় হবে না।
  • একটি পাতিলেবুর অংশ কেটে তার রস বের করে নিন। এবার লেবুর রসের সঙ্গে ২ টেবিলচামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণটি ত্বকে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে।
  • Oily skin এর সমস্যা থাকলে সম পরিমাণ শসার রস ও লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন। এতে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করে ত্বক সতেজ হবে।

চা পাতা (Tea Leaves)

চা যে শুধু শরীরের ক্লান্তি দূর করে তা নয় , চা পাতার সঠিক ব্যবহার সৌন্দর্যকেও বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। ঘরোয়া রূপচর্চায় চা পাতার সঠিক ব্যবহার ত্বকের কালচে দাগ দূর করতে, ত্বক ডিটক্সিকেট করতে এবং উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।জেনে নিন কিভাবে চা পাতা ব্যবহার করবেন।

চা পাতা কীভাবে আপনার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহার করবেন?

  • চা বানানোর পর টি ব্যাগটি ফেলে না দিয়ে ঠান্ডা হবার পর সরাসরি মুখে চেপে চেপে লাগাতে পারেন। মুখের কালচে দাগ হালকা করবে এবং ডিটক্সিকেট করবে। অবশ্য এক্ষেত্রে Green tea বেশী কার্যকর।
  • ব্যাগ দিয়ে চা করার পর সেটাকে ফেলে না দিয়ে শুকিয়ে নিন। এরপর ব্যাগটা খুলে পাতাগুলো বের করে তার সঙ্গে মধু, বেটে নেওয়া কাঁচা হলুদ মিশিয়ে মুখে ১০ মিনিট লাগিয়ে রেখে ধুয়ে নিন। এটা দারুণ স্ক্রাবার। যা ত্বকে কোনও দাগ ফেলবে না।
  • চোখের ফোলাভাব (puffiness) কমাতে বা কালচে ভাব দূর করতে চা ব্যবহার করতে পারেন। চা করার পর টি-ব্যাগ থেকে চা পাতা বের করে নিন। তার সঙ্গে অ্যালোভেরা জেল মেশান। এই মিশ্রণ চোখের চারপাশে লাগিয়ে রাখুন। এর মধ্যে দুই ফোঁটা আমন্ড অয়েল মিশিয়ে লাগালে চোখের চারপাশের কালচে ভাবও দূর হবে।
  • ত্বকে খুব তাড়াতাড়ি উজ্জ্বলতা পেতে চাইলে চায়ের লিকারের সঙ্গে এক টেবিল চামচ আমন্ড গুঁড়ো, এক টেবিল চামচ চালের গুঁড়ো এবং পরিমাণ মতো গোলাপ জল মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করুন। এটা মুখে ও গলায় লাগিয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। মুখ ধুয়ে নিলে সঙ্গে সঙ্গে ত্বক উজ্জ্বল দেখাবে।
রান্নাঘরের সাধারণ জিনিস দিয়ে ঘরোয়া রূপচর্চার গোপন রহস্য

ওটস (Oats)

যদি সকালে ওটসমিল খাওয়ার অভ্যাস থাকে, তবে তার খুব অল্প একটু অংশ সরাসরি ঘরোয়া রূপচর্চার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। ওটসে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল (antibacterial) এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি (anti inflammatory) উপাদান ত্বককে ঝকঝকে করে তোলে।

ওটস কীভাবে ব্যবহার করবেন ?

  • ওটসে আছে বিটা গ্লুক্যান, যা ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে ত্বককে আর্দ্র রাখে। ওটস থেকে আর্দ্রতা পেতে মুখে লাগাতে পারেন খুব সহজ একটি মাস্ক। এটি বানাতে লাগবে এক টেবিল চামচ ওটের গুঁড়া, এক টেবিল চামচ দুধ এবং দুই চামচ মধু। সব কটি উপাদান একসঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণ বানিয়ে সেটি ১৫ থেকে ২০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রেখে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • সেদ্ধ ওটসের সঙ্গে টমেটো মিশিয়েও বানাতে পারেন ব্রণনিরোধক মাস্ক। মাস্কটি 15 মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।

কফি (Coffee )

এক কাপ কফি যেমন আপনার দিন সুন্দর করতে পারে, কফি ত্বকের যত্নে এবং রূপচর্চায় অত্যন্ত উপকারী। ঘরোয়া রূপচর্চায় কফি ব্যবহার করে ত্বকের কালো দাগ দূর করা, ত্বক ডিটক্সিকেট করা এবং উজ্জ্বলতা বাড়ানো যায়। এক চামচ কফি আপনাকে আরো অনেক বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষমতা রাখে।

কফি কীভাবে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ব্যবহার করবেন ?

  • খুব অল্প পরিমাণ কফি পাউডারের সাথে সামান্য নারকেল তেল ভালোভাবে মিশিয়ে চোখের নীচে লাগিয়ে রাখুন ১৫-২০ মিনিট। শুকিয়ে টান লাগতে শুরু করলে ঠান্ডা জলে ধুয়ে নিন। এভাবে সপ্তাহে দু-তিন দিন করলে আস্তে আস্তে চোখের নীচের কালো দাগ (dark circles) দূর হয়ে যাবে।
  • ত্বকের উপর জরা বা বয়সের ছাপ পড়া রোধ করে কফি। কফিগুঁড়ো, কোকোয়া পাউডার ও দুধ মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। দুফোঁটা করে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে নিন তাতে। এই মাস্ক মুখে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিটের জন্য। তারপর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সহজে বলিরেখা পড়বে না।
  • দুই টেবিল চামচ কফি(coffee)এবং দুই টেবিল চামচ নারকেল তেল (coconut oil) মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে নিন। এই মিশ্রণটিই স্ক্রাবার হিসাবে খুব ভালো কাজ করবে।

শশা (Cucumber)

ঘরোয়া রূপচর্চায় বহুযুগ ধরে ব্যবহূত হয়ে আসছে শশা। টোনার (toner) থেকে শুরু করে মাস্ক (mask), স্ক্রাবার ( scrubber) শসা দিয়েই বানিয়ে ফেলতে পারবেন। রূপচর্চায় শসার ব্যবহার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নানা ভাবে শশা ব্যবহার করে সহজেই পেতে পারেন ঝলমলে ত্বক।

ত্বকের যত্নে শশা কীভাবে ব্যবহার করবেন?

  • মুখে কোনো কালো দাগ পড়লে কচি শসার রস মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ঠান্ডা জলে ধুয়ে নেবেন। এভাবে কিছুদিন নিয়মিত লাগালে দাগ উঠে যায়।
  • অনেক সময় দেখা যায় চোখের নিচে অনেকেরই কালো দাগ পড়ে। শশার রস নিয়মিত মাখলে এ দাগ দূর হবে।
  • শশা আপনার মুখের ফোলাভাব কমাতে পারে। নানা কারণেই মুখে নানা স্থানে, বিশেষ করে চোখের তলায় ফোলাভাব দেখা দেয়। সঠিক ঘুম না হলেও এমন হয়ে থাকে। শসার রস এই ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে। ত্বকের ক্লান্তিভাব কমিয়ে জেল্লা ফেরাতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়।
  • কোন মাস্ক বা প্যাক লাগানোর সময় না পেলে, পাত্রে জল ভরে তাতে শশা কেটে ফেলে রাখুন। রাতভর তেমন ভাবেই থাকতে দিন সেই জল। সকালে চোখ-মুখ ধোয়ার সময় শসা দেওয়া সেই জল ব্যবহার করুন। শসার ভিটামিন-সি আর ফলিক অ্যাসিডের সান্নিধ্যে আপনার চোখ-মুখে যেমন আরাম হবে, তেমন চেহারা থাকবে তরতাজা।

তাহলে আর দেরী নয় । আপনার রূপসৌন্দর্যের চাবিকাঠি আপনার হাতের মুঠোয়। নিজের নাগালে থাকা উপকরণ ব্যবহার করে আপনি হয়ে উঠুন অপরূপা।


Share this post: